বি. এম. জুলফিকার রায়হান, তালা
সাতক্ষীরার তালা উপজেলার দোহার গ্রামে বৃদ্ধা মাতা ছবিজান বেগম মেঝো ছেলে কাশেম খাঁর পিটুনিতে নিহত হয়েছেন নাকি তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে কাশেম খাঁ ও তার পরিবারকে ফাঁসানো হয়েছে তা নিয়ে রহস্য সৃষ্টি হয়েছে। জমি সংক্রান্ত পূর্ব বিরোধের জেরে কাশেম খাঁ ও তার পরিবারের সদস্যদের ফাঁসানোর জন্য বৃদ্ধা ছবিজানকে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে এবং ঘটনায় নিহত বৃদ্ধার দু’ ছেলের বক্তব্যে রহস্য সৃষ্টি হয়েছে। বৃদ্ধা মাতা ছবিজান বেগম হত্যা মামলার ১ নং আসামী তাঁর সন্তান কাশেম খাঁ এই অভিযোগ উত্থাপন করে নিজ মায়ের খুনের সুষ্ঠ তদন্ত পূর্বক প্রকৃত দোষীর শাস্তি দাবী করেছেন।
উপজেলার দোহার গ্রামের মৃত আলীম উদ্দীন খাঁ’র ছেলে কাশেম খাঁ বলেন, ভিটে বাড়ির জমি নিয়ে আপন ভাইদের সাথে তাঁর দীর্ঘদিন বিরোধ চলছিল। এরইমধ্যে বৃদ্ধা মায়ের কাছ থেকে ছোট ভাই বিল্লাল খাঁ কৌশলে ৫শতক জমি লিখে নিয়ে আমাদের অবরুদ্ধ করে ফেলে। এনিয়ে গত ১১ নভেম্বর দুপুরে বিল্লাল খাঁ’র সাথে তার ঝগড়া হয়। এসময় বৃদ্ধা মা ছবিজান বেগম ঘটনাস্থলে এসে আমাকে (কাশেম খাঁ) সহ আমার স্ত্রী রোজিনা বেগমকে চড়-থাপ্পড় মেরে ঝগড়া থামিয়ে দিয়ে চলে যায়। এঘটনাকে পূজি করে বিল্লাল খাঁ আমাদের হেনস্থা করার জন্য তালা থানায় গত ২৪ নভেম্বর একটি মামলা করে। এই মামলায় আমাকে সহ আমার স্ত্রী ও আমার বাড়িতে ঘটনার দিনে বেড়াতে আসা বিয়ায় (ছেলের শশুর) মো. মুকুলকে হয়রানী করার জন্য পরিকল্পিতভাবে আসামী করা হয়।
মায়ের মৃত্যুর ঘটনা বর্ননা করে কাশেম খাঁ বলেন, থানায় দায়ের হওয়া এজাহারে বাদী বিল্লাল খাঁ উল্লেখ করেছেন- ১১ নভেম্বর দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে নিজ গর্ভধারিনী মাকে আমি সহ আমার স্ত্রী ও বিয়ায় মারপিট করেছি। এমনকি আমরা হত্যার জন্য আমার মায়ের মাথায় উপর্যুপরি বাড়ি মেরেছি এবং গলা চেঁপে শ্বাসরোধে হত্যার চেষ্টা করার কারনে আমার মায়ের গলার হাড় ভেঙ্গে যায়। কিন্তু এজাহারে বর্নিত এসব অভিযোগ সম্পূর্ন মিথ্যা এবং পরিকল্পিতভাবে সাজানো। আমার গর্ভধারিণী মাকে আমি আঘাত করিনি। কাশেম খাঁ এজাহার ও ডাক্তারী সনদ উপস্থাপন করে বলেন, এজাহারে বাদী উল্লেখ করেছে যে, ১১ নভেম্বর দুপুরে আমার মাকে তালা হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং পরবর্তীতে অবস্থা আশংকাজনক হলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ উন্নত চিকিৎসার জন্য মাকে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপতালে রেফার্ড করেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, থানায় মামলা করার সুবিদার্থে ১১ নভেম্বর বিকাল ৪টার দিকে ছোট ভাই বিল্লাল খাঁ এবং আমার বৃদ্ধা মা ছবিজান বেগম সহ ৬জন তালা হাসপাতাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে সকলেই সুস্থ্যভাবে বাড়িতে ফিরে এসে ঘোরাফেরা করে। আসার আগে বিল্লাল খাঁ বাদী হয়ে থানায় একটি মিথ্যা, হয়রানীকর এজাহার জমা দিয়ে আসে। এঘটনায় তালা থানা পুলিশ সেদিন ঘটনার তদন্ত করেন এবং এজাহারে দেয়া বর্ননার সত্যতা না পেয়ে পুলিশ মামলা রেকর্ড করেনি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বিল্লাল খাঁ নানান ষড়যন্ত্র করতে থাকে। একপর্যায়ে ১১ নভেম্বর রাতে গ্রাম্য ডাক্তার মোহিতকে বাড়িতে ডেকে এনে চিকিৎসা করানোর সময় থেকে মা অসুস্থ্য হতে থাকে। পরবর্তীতে ১৪ নভেম্বর দুপুরের দিকে বিল্লাল খাঁ তালা হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার করানোর কথা বলে মাকে বাড়ি থেকে নিয়ে অজ্ঞাত স্থানে রাখে। সেসময়ে ছোট ভাই বিল্লাল খাঁ মায়ের অবস্থা আশংকাজনক দাবী করলে ২৪ নভেম্বর তালা থানায় আমাদের বিরুদ্ধে হত্যা চেষ্টার মামলাটি (৮/২৪) রেকর্ড হয়। এরপরই আমার বৃদ্ধা মা ছবিজান বেগমকে অচেতন অবস্থায় বাড়িতে ফিরিয়ে আনে বিল্লাল খাঁ। এর ৪/৫দিন পর বৃদ্ধা মা চিকিৎসা ছাড়ায় ২৭ নভেম্বর ভোর রাতে বিল্লাল খাঁ’র বাড়িতে মারা যান। মারা যাবার আগে আমি আমার মায়ের চিকিৎসা করানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও প্রতিপক্ষ ছোট ভাই বিল্লাল আমার সে সুযোগ দেয়নি। উপরন্তু মায়ের মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ আমাদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাটি হত্যা মামলা হিসেবে পেনাল কোডের ৩০২ ধারা যোগ করার জন্য ২৭ নভেম্বর বিজ্ঞ আদালতে আবেদন করেন।
এব্যপারে স্থানীয় গ্রাম্য ডাক্তার মোহিত জানান, ঘটনার পর রাতে বিল্লালের ডাকে আমি তাদের বাড়িতে যায় এবং চিকিৎসা হিসেবে ছবিজান বেগমকে বমি ও গ্যাসের ওষুদ দিয়েছিলাম। আর পরদিন থেকে ব্যথার ওষুদ খাবার পরামর্শ দিয়েছিলাম। চিকিৎসাকালে ছবিজান বেগম আমার সাথে কথা বলেন এবং মাথায় আঘাতের চিহ্ন বা গলার হাড় ভাঙ্গা দেখিনি।
এবিষয়ে ভুক্তভোগী কাশেম খাঁ তার মাকে পিটিয়ে হত্যা করার দায় অস্বীকার করে বলেন, ঘটনার দিন যদি আমরা আমার মাকে হত্যার জন্য গলার হাড় ভেঙ্গে দিতাম বা গাছের ডাল দিয়ে মাথায় উপর্যুপরি বাড়ি মারতাম তাহলে আমার মায়ের কথা বলা বা চলাফেরা করা সম্ভব হতোনা। গলার হাড় ভাঙ্গার ঘটনায় মা নিশ্চয় আশংকাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হতো। কিন্ত মা ছবিজান বেগম বাম হাতে ব্যাথার কথা বলে ও ভাই বিল্লাল খাঁ সহ ৬জন তালা হাসপাতাল থেকে সাধারন চিকিৎসা নেন। ছোট ভাই বিল্লাল খাঁসহ তার পক্ষের লোকজন জমি সংক্রান্ত পূর্ব বিরোধে আমাদের ফাঁসানোর জন্য পরিকল্পিত ভাবে আমাদের বৃদ্ধা মাকে খুন করে উল্টো আমাদের হত্যা মামলার আসামী করেছে। তাছাড়া, বিল্লাল খাঁ ও তার পরিবারের লোকজন আমার বসতঘর, আসবাবপত্র ও গাছপালা ভাংচুর সহ ঘর থেকে টাকা ও মূল্যবান মালামাল লুটপাট করে।
এবিষয়ে তালা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. রাজিব সরদার জানান, বৃদ্ধা ছবিজান বেগম ১১ নভেম্বর ২০২৪ তারিখ বিকাল ৪টা ৫মিনিটে মারামারির ঘটনায় বাম হাতে ব্যথাজনিত রোগে তালা হাসপাতালে আসেন। এসময়ে তিনি প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহন শেষে হাসপাতালে ভর্তি না হয়ে চলে যান। এবিষয়ে ইতোমধ্যে তালা থানা পুলিশকে জখম সংক্রান্ত ডাক্তারী সনদ প্রদান করা হয়েছে।
এব্যপারে মামলার বর্তমান তদন্তকারী কর্মকর্তা তালা থানার এসআই শেখ মো. গোলাম আযম জানান, এই মামলাটির মেডিকেল সনদ পাওয়ার পর নানান রহস্য তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, বৃদ্ধা ছবিজান বেগমের মরদেহের ময়না তদন্ত রিপোর্ট আসার পর মৃত্যুর সঠিক কারন জানা যাবে। এই মামলার ৩জন আসামী বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। ঘটনার প্রয়োজনীয় এবং সুষ্ঠ তদন্ত করে বিজ্ঞ আদালতে দ্রæত রিপোর্ট জমা দেয়া হবে।
এঘটনায় মামলার বাদী বিল্লাল খাঁ আবারও বলেন, তাঁর মাকে ১১ নভেম্বর ২৪ তারিখে মেঝো ভাই কাশেম খাঁ, তাঁর স্ত্রী রোজিনা বেগম ও তাদের বিয়ায় মুকুল মারপিট করে গলার হাড় ভেঙ্গে দেয় ও মাথায় উপর্যুপরি বাড়ি মারলে মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ হলে আশংকাজনক অবস্থায় তালা হাসপতালে ভর্তি করেন। পরবর্তীতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মাকে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরন করেন এবং তাদের মারপিটের কারনে মা মারা গেছে। কিন্তু তাঁর এই বক্তব্যের স্বপক্ষে হাসপাতাল বা চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজপত্র দেখতে চাইলে তিনি যথাযথ কোনও কাগজপত্র বা তথ্য প্রদান করতে পারেননি।
এদিকে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দোহার গ্রামের একাধিক ব্যক্তি ঘটনার পূর্ন তদন্ত পূর্বক বৃদ্ধা মাতা ছবিজান বেগমকে হত্যার সাথে জড়িত প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য প্রশাসনের নিকট জোর দাবী জানিয়েছেন।